উদ্যান উন্নয়নের নামে গাছের পাড় বাঁধাইকাজে অভাবিত টাকা ব্যয় হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) একটি প্রকল্পে। সেখানে একেকটি গাছের গোড়া কংক্রিট দিয়ে বাঁধাই করতে গড়ে ব্যয় করা হয়েছে ৪৩ লাখ ৫৩ হাজার টাকার মতো। আর সব মিলিয়ে ছোট-বড় ৪১টি গাছের গোড়া বাঁধাতে খরচ দেখানো হয়েছে ১৬ কোটি ২৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। ডিএসসিসির ‘ওসমানী উদ্যান উন্নয়ন প্রকল্পে’ এমন অর্থ ব্যয়ের ঘটনা ঘটেছে। তবে এখানেই শেষ নয়, ব্যয়ের হিসাব প্রকল্পের কাগজপত্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে কোনো প্রকল্পের কাগজপত্রে যা হয় না। যাতে একটি গাছের জন্য যে কমবেশি প্রায় অর্ধ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে তা যেন সহজে চোখে না পড়ে। গাছরক্ষার নামে এমন অবাস্তব খরচ দেখে খোদ নগর ভবনেরই অনেকে রীতিমতো হতবাক।
ওসমানী উদ্যানে ডিএসসিসির গাছরক্ষার ওই প্রকল্প এলাকায় ছোট, বড় ও মাঝারি আকারের ৪০/৪২টি গাছ পড়েছে। এর বেশিরভাগই রেইন ট্রি। সঙ্গে আম, কৃষ্ণচূড়া আর মেহগনিও আছে। এসব গাছের জন্য তৈরি করা হয়েছে কংক্রিটের বেশকিছু ব্লক। ছোট-বড় এসব প্রত্যেকটি ব্লকের জন্য খরচ হয়েছে ৬৬ লাখ ১৩ হাজার টাকা। সেখানে একেকটি গাছের পাড় বাঁধানোর কাজে ব্যয় করা হয়েছে ৪৩ লাখ ৫৩ হাজার টাকার মতো। সব মিলিয়ে এসব কাজের জন্য সংশ্লিষ্টরা খরচ দেখিয়েছে ১৬ কোটি ২৪ লাখ ২০ হাজার টাকা।
ওসমানী উদ্যান উন্নয়নকাজের তিনটি প্যাকেজের প্রথমটি থেকে ইতিমধ্যে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সবমিলিয়ে ২৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা তুলে নিয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে ও প্রকল্পের নথিপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রাজধানীর এ উদ্যানের উন্নয়নকাজে তিনটি প্যাকেজে মোট ৮৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকার প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করা হয়েছিল। প্রকল্পের তিনটি প্যাকেজের কাজের বিপরীতে সবমিলিয়ে ৪৯ কোটি টাকার মতো বিল ইতিমধ্যে তুলে নিয়েছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান।
৪১ গাছে যেভাবে ১৬ কোটি ২০ লাখ টাকা খরচ : হাতে আসা নথিপত্র ঘেঁটে ও প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, প্রকল্পটির প্রথম প্যাকেজে ঠিকাদারের সঙ্গে মোট ২৭ কোটি ৩৬ লাখ টাকার চুক্তি করা হলেও একপর্যায়ে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকায়। প্যাকেজ-২ এ ব্যয় ধরা হয়েছে ২৯ কোটি ৯৮ লাখ এবং প্যাকেজ-৩ এ ব্যয় ধরা হয়েছে ২৯ কোটি ৬২ লাখ টাকা। সবমিলিয়ে তিনটি প্যাকেজে ৮৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়। এ প্রকল্পের কাগজপত্রে ব্লকের কথা উল্লেখ না থাকলেও বাস্তবায়নের সময় ব্লকভিত্তিক কাজ করা হয়েছে। সেখানে দেখা যায় ছোট, মাঝারি ও বড় আকারের ৪০-৪২ গাছকে বেশকিছু ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। কোনো কোনো ব্লকে একাধিক গাছ থাকলেও বেশিরভাগ ব্লকেই একটি করে গাছ রয়েছে। সেখানে তিনটি গাছ নিয়ে সবচেয়ে বড় ব্লকটি করা হয়েছে। যাতে খরচ দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৭০ লাখ টাকার মতো। এছাড়া প্রতিটি ব্লকের জন্য কমবেশি খরচ হয়েছে ৬৬ লাখ টাকারও বেশি। এতে গাছপ্রতি ৪৩ লাখ ৫৩ হাজার টাকার মতো ব্যয় হয়েছে। প্রতিটি ব্লক নির্মাণে খরচ করা অর্থ ভেঙে ভেঙে হিসাব করলে দেখা যায়, পাইল (গর্ত) বাবদ ১৬ লাখ ১২ হাজার টাকা, পাইল ঢালাই প্রায় ২৯ লাখ টাকা, পাইলের মাথা ভাঙায় প্রায় ৩০ হাজার, পাইল পরিষ্কারে ৪ লাখ ৩০ হাজার, পাইল রডের জন্য সাড়ে ৪ লাখ, আরসিসি দেয়াল ঢালাইয়ে ৫ লাখ ৭১ হাজার, রডের জন্য প্রায় আড়াই লাখ, শাটারিংয়ে ১ লাখ ১০ হাজার, এসকাস্ট ১৫ হাজার, ইটের দেয়ালে ২ লাখ ৩০ হাজার, মাটি ভরাটে ৭ হাজার ও বালু ভরাটে ৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। ছোট সবগুলো ব্লক নির্মাণে ১৪ কোটি ৫৪ লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। আর তিনটি গাছ নিয়ে থাকা একটি বড় ব্লকে খরচ দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। গড়ে একেকটি ব্লকের জন্য ৬৬ লাখ ১০ হাজার টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। আর সবগুলো ব্লকের জন্য মোট ১৬ কোটি ২৪ লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ দেখানো হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, এ কাজের কাগজপত্র এলোমেলোভাবে তৈরি করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে কোনো প্রকল্পের কাগজপত্র এমন হয় না। প্রকল্পের পুরো তিনটা প্যাকেজ একটা আরেকটার সঙ্গে মিশিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ব্যয় হিসাব তৈরি হয়েছে। যাতে সহজে এসব গাছের জন্য কত টাকা খরচ হয়েছে তা যেন চোখে না পড়ে। উদাহরণ দিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, এখানে প্যাকেজ-১ এ শুধুমাত্র পাইলিংয়ের জন্য ১৩টি প্লান্টারে ১ কোটি ৯৯ লাখ ৮৭ হাজার ২১২ টাকা খরচ করা হয়েছে। আবার আলাদাভাবে পাইল কাস্টিংয়ে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৩ কোটি ৫৭ লাখ ২৯ হাজার ৬২০ টাকা। এরপর প্লান্টারের অন্যসব উপকরণের হিসাব আর এখানে দেওয়া হয়নি। পাইল কাস্টিংয়ের জন্য যে ১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৫৫ টাকার পলিথিন ধরা হয়েছে সেটিও নিয়ে যাওয়া হয়েছে অন্য প্যাকেজে। প্লান্টারের সব রডের হিসাব প্যাকেজ-২ এ দেখানো হয়েছে। প্যাকেজ-৩ এ প্লান্টারের শাটারিং ও আরসিসি ঢালাই দেখানো হয়েছে। এখানে ব্যয় ১ কোটি ৫২ লাখ ৯৯ হাজার ৩৬৩ টাকা। এভাবে ব্যয় হিসাব প্রকল্পের কাগজপত্রে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে সহজেই কেউ বুঝবেই না যে একটি গাছের জন্য কমবেশি প্রায় অর্ধ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে।
এ প্রকল্পের প্লান্টারের নকশা দেখে দক্ষ প্রকৌশলীরা বলেন, প্রতিটি প্লান্টারের কাজের বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়নি। ডিজাইন অনুযায়ী ১৮ ইঞ্চি ব্যাসের সোর পাইলের কথা বলা হলেও এর গভীরতার কথা বলা হয়নি। আবার ১০ ইঞ্চি পুরুত্বের ১২ ফুট গভীরের রিটেইনিং ওয়ালের কথা উল্লেখ করে লেকের তলদেশেও ঢালাইয়ের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ ঢালাইয়ের গভীরতা কত তা বলা হয়নি। ফলে প্রকৃতপক্ষে কত গভীরে পাইলিং করা হয়েছে বা ঢালাই আছে তাও বোঝা যাচ্ছে না। এখানে পাইল ইন্টিগ্রিটি টেস্ট বা এমবির তথ্য ছাড়া প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাবে না।
প্রকল্পের শুরু : ২০১৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান দি বিল্ডার্স ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের সঙ্গে ২৭ কোটি ৩৬ লাখ ৯৯ হাজার ২১৯ টাকার একটি কার্যচুক্তি করে ডিএসসিসি। পরে ২০১৮ সালের ২৭ জানুয়ারি রাজধানীর ওসমানী উদ্যানে ‘গোস্বা নিবারণী’ নাম দিয়ে পার্কের কাজের উদ্বোধন করা হয়। প্রকল্পটির (প্যাকেজ-১) কাজ কিছু দূর এগোনোর পর ২০১৯ সালের ১৬ অক্টোবর তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী তানভীর আহমদ, সাইফুল ইসলাম জয়, ড. শফীউল্লাহ সিদ্দিকী ভূইয়া এবং তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মুন্সী মো. আবুল হাসেম প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ব্যয় আরও ২ কোটি ৫৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা বাড়িয়ে ২৯ কোটি ৯৫ লাখ ৬৯ হাজার টাকার প্রাক্কলন অনুমোদন করেন। সেখানে কাজের বিপরীতে ইতিমধ্যে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ২৪ কোটি ৩০ লাখ টাকার বিল নিয়েছে। দীর্ঘ সময় কাজ বন্ধ থাকায় পাবলিক প্রকিউরম্যান্ট রুলস (পিপিআর) ২০০৮, অনুযায়ী ডিএসসিসির পক্ষ থেকে সম্প্রতি ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের এ প্রকল্পটি পরের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও পরে বরাদ্দ বাড়ার সঙ্গে মেয়াদও বাড়িয়ে ২০২০ সালের ৩০ ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু এ কাজের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান দি বিল্ডার্সের মালিক বিতর্কিত ঠিকাদার জিকে শামীমের ব্যবসায়িক অংশীদার ফজলুল করিম চৌধুরী ওরফে স্বপন তা শেষ করতে পারেননি। জিকে শামীম গ্রেপ্তার হওয়ার পর ঠিকাদার স্বপন দীর্ঘদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকেন। এরই মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে ওসমানী উদ্যানসহ তার প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকা ডিএসসিসির আরও কয়েকটি প্রকল্প।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মুন্সী মো. আবুল হাশেম বলেন, ‘এ কাজগুলো আমি দায়িত্ব নেওয়ার অনেক আগেই হয়েছে। আমরা সব হিসাব করছি। এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি। কোন কাজে কত খরচ হয়েছে তা বলতে পারব না। তবে কাজের বেশি বিল দেওয়া হয়নি। এ ঠিকাদারের সঙ্গে ডিএসসিসির চুক্তি বাতিল হচ্ছে।’
আর ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) ফরিদ আহাম্মদ বলেছেন, ‘কাজটি যে সালে করা হয়েছে সেই সালে যারা দায়িত্বে ছিল তারা তা বলতে পারবে। ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি বাতিল হওয়ার পর কোনো কিছু হয়ে থাকলে আমরা বলতে পারব। করপোরেশনের শ’খানেক প্রকল্প আছে। প্রত্যেক প্রকল্পের বিষয়ে আমি কিংবা আমাদের প্রধান প্রকৌশলীও কম্পোনেন্ট ধরে ধরে বলতে পারব না।’
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ডিএসসিসির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। পরে কল করার কারণ জানিয়ে তার মোবাইল ফোনে বার্তা পাঠানো হলে ফিরতি বার্তায় তিনি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। জনসংযোগ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও এ ব্যাপারে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।