ঘুরে দাঁড়াচ্ছে আওয়ামী লীগ ত্যাগী নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত

রাজনীতি সর্বশেষ

প্রায় এক যুগ পর ফরিদপুরে সীমাহীন এক দুঃশাসনের পতন ঘটেছে। সদলবলে অবসান হয়েছে মন্ত্রী মোশাররফ যুগের।

একে একে অত্যাচারী শাসকের প্রথমসারির পাইক-পেয়াদা পুলিশের খাঁচায় এখন বন্দি। কারও বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। কারও তদন্ত শেষ। দেওয়া হয়েছে চার্জশিট। কেউ গ্রেফতার এড়াতে আছে আত্মগোপনে। তবে এসব খবর শুনে বহুদিন পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন ফরিদপুরবাসী।

বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীরাও খুবই উৎপুল্ল এবং উজ্জীবিত। এমন একটি অবিশ্বাস্য, অথচ সবার প্রত্যাশিত পরিবেশ নিশ্চিত করায় তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।

ত্রাস সৃষ্টিকারী খলনায়ক দলের অন্যতম দুই হোতা সহোদর সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও ইমতিয়াজ হাসান রুবেল গ্রেফতার হওয়ায় নতুন এক সকালের দেখা পান ফরিদপুরবাসী। সবার মধ্যে সেদিন কারামুক্তির আনন্দ ভর করে। এরপর এলাকা ধরে ধরে গ্রেফতার হতে থাকে অত্যাচারী রাজার চ্যালা-চামুণ্ডারা। সবশেষে দুই হাজার কোটি টাকা পাচারের মামলায় অন্যতম ক্রীড়নক ফোয়াদ সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়ার পর

অত্যাচারী রাজার মসনদ তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। স্থানীয় সাধারণ মানুষের মতে, দেশ স্বাধীনের পর ফরিদপুরবাসী দ্বিতীয়বারের মতো মুক্তির স্বাদ পেয়েছেন।

ফরিদপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবিতে অবস্থান করছেন জানিয়ে  বলেন, গত এক যুগে ফরিদপুরে যে উন্নয়ন করেছি তা আগামী ১শ বছরে কেউ করতে পারবে না। অনেকে বলেন, আমি ফরিদপুরে যাই না। তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, করোনা মহামারিতে ফরিদপুুরে যে অবস্থা এর মধ্যে সেখানে গিয়ে আমার জীবন শেষ করতে চাই না। তাদের জীবনের মূল্য আছে, আমার জীবনের মূল্য কি নেই? আমার কাছে থেকে যারা আমাকে ব্যবহার করে বা আমার নাম ভাঙিয়ে অগাধ টাকার মালিক হয়েছে তার জন্য আমি দায়ী নই। যে ডিপার্টমেন্টের নির্বাহীরা টেন্ডার পাওয়া ও টাকা পয়সা আয়ের সুযোগ করে দিয়েছে তাদের তো কেউ কিছু বলছে না।

তিনি বলেন, আমার নাতি-নাতনি এবং পরিবারের সদস্যরা না চাইলে আমি কিভাবে ফরিদপুরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হবো।

তিনি আক্ষেপ করে আরও বলেন, আওয়ামী লীগের শামীম হক, যার নামের আগে হল্যান্ড যুক্ত তার কথায় এবং কি যেন নিক্সন চৌধুরী আমাকে গালাগাল করে- এমন অর্বাচীনের কথায় ফরিদপুর গিয়ে জবাব দিতে হবে? আমার ৮২ বছর বয়সে ওইসব অর্বাচীনদের গালাগালের জবাব দেয়া উচিত হবে? আমার মানসম্মান আছে, তা খোয়াতে চাই না।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, গত বছরের জুনে বরকত-রুবেল গ্রেফতার হন। তাদের এ গ্রেফতারটি ছিল ফরিদপুর সদরের সংসদ সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনের জন্য কঠিন এক বার্তা। কারণ, মোশাররফ হোসেনের ডান হাত বলে পরিচিত এই দুই সহোদরকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারে(!) এটিই ছিল সবার কাছে অবিশ্বাস্য এক সংবাদ।

কিন্তু বাস্তবে যখন খবরটি সবার কাছে সত্য সংবাদ হিসাবে ধরা দেয়, তখন মোশাররফ হোসেনও বুঝে যান তার দিন শেষ। ওই ঘটনার পর তিনি প্রশাসনের কোনো সহায়তা না পেয়ে অনেকটা ক্ষোভে-দুঃখে ফরিদপুর ত্যাগ করেন। এরপর জরুরি প্রয়োজন ছাড়া আর ফরিদপুরমুখো হননি।

গত ১৬ মাসে স্বল্প সময়ের জন্য ৩ দিন তিনি ফরিদপুরে পা রাখেন। তাবৎ ফরিদপুর তার অসীম শক্তির উত্তাপ যারা ছড়াতেন তাদের মধ্যে অন্তত ২৫ জন এ পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছে বিভিন্ন মামলায়।

তবে এরমধ্যে সবচেয়ে বড় আঘাত আসে ১২ অক্টোবর। ওইদিন রাতে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে ঢাকার বসুন্ধরা এলাকা থেকে গ্রেফতার হন সাবেক এই মন্ত্রীর এপিএসখ্যাত এএইচএম ফোয়াদ। যার বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর ছোটন হত্যাসহ ৮টি মামলা রয়েছে। ৭টি মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। দুই হাজার কোটি টাকা পাচার মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামিও তিনি। এ ফোয়াদ গ্রেফতারের খবর ছিল তার কাছে বিনা মেঘে বজ পাতের মতো। এরপর তিনি দেশ ত্যাগ করেন।

এদিকে প্রভাবশালী সংসদ সদস্যের ক্ষমতার মসনদ ভেঙে খান খান হয়ে যাওয়ায় আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীরা কেউ ঘরমুখো এবং কেউ ঘর থেকে বেরিয়ে রাজপথে আসতে শুরু করেন। এছাড়া যারা শত জুলুম-নির্যাতনের মুখে আগে থেকে অকুতোভয় সৈনিকের মতো রাজপথে সক্রিয় ছিলেন তারা আরও সোচ্চার হন।

নানাভাবে বিভক্ত আওয়ামী লীগকে পুনরুদ্ধার করতে সিনিয়র নেতাদের অনেকে এগিয়ে আসেন। যদিও শুরুর দিকটা এগোতে থাকে ত্রিধারায়। এরমধ্যে একটি ধারার নেতৃত্বে আসেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবল চন্দ্র সাহা ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ হোসেন। আরেকটি ধারার নেতৃত্বে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শামসুল হক ভোলা মাস্টার, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শামীম হক।

তৃতীয় ধারাটি ধরে রাখেন খন্দকার মোশাররফপন্থি হিসাবে পরিচিত নেতা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক মোল্লা।

এ প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফরিদপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান ও যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফরিদপুর-৪ আসনের স্বতন্ত্র সাংসদ মজিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে নিক্সন চৌধুরী ফরিদপুর সদরে রাজনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়ে দেন। তৎপরতার অংশ হিসাবে আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাম পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘোষণা করা হয়। নিক্সন চৌধুরী ফরিদপুরে শামছুল হক ভোলা মাস্টারের ফরিদপুরের বাড়িতে এক অনুষ্ঠানে এসে ত্যাগী নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করতে সাহসী বক্তৃতায় সবাইকে উজ্জীবিত করেন।

এদিকে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শামছুল হক ভোলা মাস্টার ও আওয়ামী লীগ নেতা খলিফা কামালউদ্দিন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি একে আজাদকে নিয়ে এক বক্তৃতায় কটূক্তি করে বসেন।

এরফলে রাজনীতির জল কিছুটা ঘোলা হয়। তবে তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। পরে এক সভায় কোলাকুলি করে বিভেদের ব্যবধান ঘুচিয়ে ফেলেন। এছাড়া এসব বিভেদের অবসান ঘটাতে ফরিদপুর-৪ আসনের স্বতন্ত্র সাংসদ মজিবুর রহমান নিক্সন চৌধুরী ফরিদপুরের অম্বিকা হলে ১৫ আগস্টের অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির হিসাবে বিশেষ বক্তৃতা করেন।

সেখানে তিনি খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে নিয়ে কড়া সমালোচনা করা ছাড়াও নিজের রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার করে দেন। তিনি সভায় সাফ জানিয়ে দেন, ফরিদপুর সদরে রাজনীতি করতে আসবেন না।

এছাড়া ফরিদপুরে শুদ্ধি অভিযানে সাহসী ভূমিকা রাখার জন্য পুলিশ সুপার মো. আলিমুজ্জামানের (বিপিএম) ভূয়সী প্রশংসা করেন। ফলে ফরিদপুর সদর আসন থেকে ভবিষ্যতে শিল্পপতি একে আজাদের মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়টি অনেকটা স্পষ্ট হতে শুরু করে। এই যখন অবস্থা তখন ফরিদপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমানও নিজেকে ফরিদপুর সদর থেকে অনেকটা গুটিয়ে নেন। বর্তমানে তিনি ফরিদপুরে আসা কমিয়ে দিয়েছেন।

এর ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ নেতাদের এক ধারায় আসতে সম্প্রতি ফরিদপুর শহরের লাবলু সড়কে জেলা আওয়ামী লীগের ডাকা এক সমাবেশে সবার কণ্ঠে ঐক্যের সুর প্রতিধ্বনিত হয়। সবাই একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার ঘোষণা দেন।

সমাবেশে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুবল চন্দ্র সাহার সভাপতিত্বে বক্তৃতা করেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাবেক কার্যনির্বাহী সদস্য বিপুল ঘোষ, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শামীম হক, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি একে আজাদ, জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ হোসেন, পৌর মেয়র অমিতাভ বোস, যুবলীগ নেতা ফারুক হোসেন, মনিরুল হাসান মিঠু, ঝর্ণা হাসান, আইভি মাসুদ, শামছুল আলম চৌধুরী প্রমুখ। ওই সভার মধ্য দিয়ে ফরিদপুরে আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীরা সবাই এক কাতারে শামিল হয়ে যান।

তবে এখনো ফরিদপুরে আওয়ামী লীগের দুটি ধারা বিরাজমান রয়েছে বলে কেউ মনে করেন। তাদের মতে, ফরিদপুর সদরের রাজনীতিতে একটি ধারায় রয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ এবং অপর ধারাটির নেতৃত্বে রয়েছেন যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মজিবুর রহমান নিক্সন চৌধুরী। সেটিও সহসা এক মেলবন্ধনে মিলে যেতে পারে। এমন আভাসের সুবাতাস পর্দার আড়ালে বইতে শুরু করেছে।

ফরিদপুরে অপরাজনীতির বিরুদ্ধে সাহসী শুদ্ধি অভিযানের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সুবল চন্দ্র সাহা। তিনি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে  বলেন, ‘ন্যায্য কথা বলতে গিয়ে সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান এমপি খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সময় আমার বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর ফরিদপুরে শুদ্ধি অভিযান শুরু হয় এবং খন্দকার মোশাররফ হোসেনের অনুসারীদের অনেকে আটক হন। দ্রুত পট পাল্টাতে থাকে। সবার মধ্যে স্বস্তি নেমে আসে। এজন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি এবং আমার পরিবার আজীবন ঋণী হয়ে থাকব।’ তিনি বলেন, ‘আগে দলের ত্যাগী নেতারা কেউ সঠিক কথা বলতে পারতেন না। এখন আমরা কথা বলতে পারছি। দলের মধ্যে ভিন্নমত থাকতে পারে, এটা গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। তবে কেউ কেউ এখনো স্যাবোটাজ করে বিভেদ সৃষ্টি করতে চায়। কিন্তু আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকলে অপশক্তি আর সফল হবে না।’

সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক মোল্লা বলেন, ‘দলের মধ্যে এখনো বিভেদ আছে সেটি এখন আর বলার অবকাশ নেই।’

জেলা আওয়ামী লীগ নেতা ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শামছুল হক (ভোলা মাস্টার)  বলেন, ‘খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সময়ে পুলিশের শুদ্ধি অভিযানে দলের সুবিধাভোগী, হাইব্রিড নেতারা আটক হলেও সেই সময়কার অনেকে এখন ভোল পাল্টে দলে ফেরার চেষ্টা করছেন। তাদরে বিষয়ে প্রত্যেককে সতর্ক হতে হবে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘অনেক প্রোগ্রাম আমাকে জানানো হয় না, এটা দুঃখজনক। তিনি মনে করেন, ‘ফরিদপুরে শুদ্ধি অভিযান হয়েছে। এখন দলের মধ্যে শুদ্ধি অভিযান প্রয়োজন। বিশেষ করে সবার আগে হাইব্রিড নেতাদের বাদ দিয়ে জেলা কমিটির কাউন্সিল করা প্রয়োজন।’

 

121Shares
facebook sharing button
messenger sharing button
whatsapp sharing button
twitter sharing button
linkedin sharing button

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *