চোরাই মদ, সিসা ও বিয়ারের উৎস খোঁজার নির্দেশ

জীবনযাপন দুর্নীতি দমন মফস্বল সর্বশেষ

আমদানি নিষিদ্ধ চোরাই বিদেশি মদ সিসা ও বিয়ারের উৎস খোঁজার নির্দেশ দিয়েছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (নারকোটিক্স) ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক আজিজুল ইসলাম। বুধবার সকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় নারকোটিক্সের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক জরুরি সভায় এ নির্দেশনা দেন তিনি। এ সময় বার, ক্লাব ও হোটেলগুলোকে বিশেষ নজরদারির আওতায় আনতে বলা হয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আনা বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদের চালান ধরা পাড়ায় নড়েচড়ে বসে নারকোটিক্স। এসব চোরাই মদ রাজধানীর বিভিন্ন বার, ক্লাব ও হোটেলে বিক্রি হচ্ছে এমন খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। চোরাইপথে আনা বিদেশি মদ-বিয়ার নিয়ন্ত্রণের উপায় খুঁজতে জরুরি সভা ডাকেন ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক। এতে নারকোটিক্সের পরিদর্শক থেকে তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার কর্মকর্তারা অংশ নেন।

বৈঠক সূত্র জানায়, বেলা সাড়ে ১১টায় আলোচনা শুরু হয়। শুরুতে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আসা বিদেশি মদ-বিয়ার ও পত্রিকায় প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা হয়। মাঠের বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বৈঠকের শুরুতে এক কর্মকর্তা বলেন, ‘মিথ্যা ঘোষণায় আনা বিদেশি মদ-বিয়ার ছাড়াও ডিপ্লোমেটিক বন্ডেড ওয়্যারহাউজগুলো চোরাই মদের অন্যতম বড় উৎস। কিন্তু আইনগত সীমাবদ্ধতার কারণে সেখানে নারকোটিক্স অভিযান চালাতে পারে না। তাছাড়া কয়েকটি বার, ক্লাব ও হোটেল প্রভাবশালীদের শেল্টারে চলছে। বিশেষ করে গুলশান-২ ও উত্তরায় অবস্থিত কিং ফিশার বারের মালিক জনৈক মুক্তার এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে চলেন। তার মালিকানাধীন বারে চোরাই মদের কারবার চলে প্রকাশ্যে। সেখানে বার পরিচালনা সংক্রান্ত নিয়মের ছিটেফোঁটাও মানা হচ্ছে না। অথচ বারটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।’

ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক বলেন, কয়েকদিনের মধ্যেই নতুন ডিজি যোগদান করবেন। এরপর তিনি এ বিষয়ে আরও কঠোর নির্দেশনা দেবেন। তবে অবৈধ মদ-বিয়ার বিক্রিতে ছাড় দেওয়া চলবে না। ডিপ্লোমেটিক বন্ডেড ওয়্যারহাউজে প্রবেশ করতে না পারলে রাস্তায় অভিযান চালাতে হবে। মদ-বিয়ার আটকের পর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেও মামলা করতে হবে।

ঢাকা মেট্রো-উত্তরের সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসান চোরাই মদ-বিয়ার নিয়ন্ত্রণে বিশেষ কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন। এছাড়া ইন্সপেক্টরসহ সংশ্লিষ্ট সার্কেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাদকবিরোধী অভিযানে আরও তৎপর হতে বলেন তিনি।

অধিদপ্তরের পরিচালক অপারেশন উপমহাপুলিশ পরিদর্শক কুসুম দেওয়ান সম্প্রতি র‌্যাবের হাতে আটক বিদেশি মদের চালানের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘সব মদ ঢাকায় কীভাবে ঢুকল এবং এগুলোর গন্তব্যের ঠিকানা খুঁজে বের করতে হবে। মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে বিদেশি মদের বিশাল গোডাউন থাকলেও এতদিন এর খোঁজ কেন জানা যায়নি সে প্রশ্ন তোলা হয়। তবে সভায় উপস্থিত কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এর কোনো সদুত্তর মেলেনি।’

ঢাকা মেট্রো উত্তরের উপপরিচালক রাশেদুজ্জামান বলেন, চোরাই বিদেশি মদ বিয়ারের পাশাপাশি সিসা নিয়ন্ত্রণ করাও জরুরি। রাজধানীতে ৪২টির মতো সিসা লাউঞ্জে প্রকাশ্যে সিসা সেবন করা হচ্ছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। সিসা জব্দ করে রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পাঠানো হলেও যথাসময়ে রিপোর্ট আসছে না। ফলে অভিযান বিলম্বিত হচ্ছে।

সভায় উল্লেখ করা হয়, ৭টি সিসা লাউঞ্জ উচ্চ আদালতে রিট দায়ের করেছে। নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালানোর ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা আছে। তবে যেসব প্রতিষ্ঠানে নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি নিকোটিনযুক্ত সিসা পরিবেশন করা হচ্ছে সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

সভায় উপস্থিত এক কর্মকর্তা মাদকবিরোধী অভিযান এবং সোর্সমানি নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে মাদকের বড় মামলাগুলো হচ্ছে এনটিএমসি’র (ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার) সহায়তা। তাহলে সোর্সমানি যাচ্ছে কোথায়। নিজস্ব সোর্সে মাদক উদ্ধার বা মামলার সংখ্যা একেবারেই কমে গেছে। ফলে পুরো মাদকবিরোধী অভিযানে স্থবিরতা নেমে এসেছে।’

সূত্রাপুর সার্কেলের ইন্সপেক্টর জিল্লুর রহমান বলেন, বিদেশি মদ বিয়ারসহ অবৈধ মাদক চোরাচালান রোধে বন্দরগুলোতে নারকোটিক্সের জনবল নিয়োগের বিধান রয়েছে। কিন্তু কাস্টমসের বাধায় তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এক্ষেত্রে জটিলতা নিরসনের এনবিআর (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) চেয়ারম্যানকে চিঠি দেওয়া হবে বলে সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক আজিজুল ইসলাম বিকালে তার কার্যালয়ে  বলেন, ‘অবৈধ মদ-বিয়ার যাতে অধিদপ্তরের আওতাধীন বারগুলোতে কোনোভাবেই বিক্রি হতে না পারে সে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে নারকোটিক্সের পক্ষ থেকে বিশেষ অভিযান চালানো হবে। এছাড়া অধিদপ্তরের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়া হচ্ছে। কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, গুলশানের র-ক্যানভাস, কোরিয়ান ক্লাব (কেবি) ও বাংলামোটর এলাকায় শ্যালেসহ কয়েকটি বার কর্তৃপক্ষ নিয়ম ভেঙে শুক্রবারেও ব্যবসা পরিচালনা করছে। এমনকি কয়েকটি বারে টিকিট বিক্রির মাধ্যমে অবৈধ গান ও নাচের অনুষ্ঠান করা হচ্ছে। এছাড়া গুলশানের হোটেল সারিনা ও রমনার ঈশাখাঁ হোটেলে বার খোলা রাখা হচ্ছে গভীর রাত পর্যন্ত।

প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে অবৈধ মদের ব্যবসা করছে গুলশানের ক্যাপিটাল ক্লাব, অল-কমিউনিটি ক্লাব, বনানী ক্লাব এবং উত্তরা ক্লাবসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। গুলশানে ৮৯ ক্লাব নামে একটি অবৈধ বার চলছে খোদ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কতিপয় কর্মকর্তার নাম ভাঙিয়ে। নারকোটিক্সের চট্টগ্রাম অঞ্চলে কর্মরত এক অতিরিক্ত পরিচালকসহ কয়েকজন কর্মকর্তা ৮৯ ক্লাব বারের ব্যবসায়িক অংশীদার। ফলে সেখানে অভিযান চালানো যাচ্ছে না।

অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, ‘আইন সবার জন্য সমান। কেউ প্রভাবশালী মহলের আশীর্বাদপুষ্ট হলে তার ব্যক্তিগত এবং প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে গোপনীয় প্রতিবেদন তৈরি করে মন্ত্রণালয়সহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ে পাঠানো হবে। এতেও কাজ না হলে ভিন্ন উপায়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু আইন ভাঙার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হতে দেওয়া যাবে না।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *