জাহাঙ্গীর, সম্পদের পাহাড়চূড়ায় ওঠার আদ্যোপান্ত। 

অপরাধ

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ) পরিচয় দিয়ে মো. জাহাঙ্গীর আলম অনৈতিক কাজ করছেন বলে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর বিষয়টি এখন নোয়াখালীর মানুষের মুখে মুখে। বুধবার পর্যন্ত নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী হিসেবেই সব জায়গায় পরিচয় দিতেন তিনি। এবারের সংসদ নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন না পেয়ে জাহাঙ্গীর নোয়াখালী-১ (চাটখিল-সোনাইমুড়ী) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে নেমেছেন। নতুন করে আলোচনায় এসেছে তাঁর নির্বাচনী হলফনামা, যেখানে আছে সম্পদের পাহাড়চূড়ায় ওঠার আদ্যোপান্ত।

স্থানীয়রা জানান, ৯০ দশকে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাড়ি সুধাসদনে আসা দলীয় নেতাকর্মীকে পানি খাওয়ানোর কাজ করতেন জাহাঙ্গীর আলম। নোয়াখালী থেকে আসা এই জাহাঙ্গীরকে নেতাকর্মীরা তখন থেকে ‘পানি জাহাঙ্গীর’ নামে চিনতেন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রীর এক বিশেষ সহকারীর (বর্তমানে এমপি) মাধ্যমে গণভবনে যাতায়াতের সুযোগ পান জাহাঙ্গীর। এর পর থেকে মো. জাহাঙ্গীর আলম নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয় দিতেন। এ পরিচয় দিয়ে তিনি নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক কমিটির সহসভাপতির পদ বাগিয়ে নেন। করতেন নানা তদবির।

প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকেও বলা হয়, জাহাঙ্গীর প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয় দিয়ে অনৈতিক কাজ করছেন। এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার জন্য অনুরোধ করা হয়। প্রয়োজনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তা নিতে বলা হয়। একসময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী জাহাঙ্গীরের বিষয়ে হঠাৎ করে এমন সতর্ক বার্তায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অনেকে।

স্থানীয়রা জানান, জাহাঙ্গীর এত বছর প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী পরিচয়ে ক্ষমতার দাপট দেখিয়েছেন। নোয়াখালী আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার, নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, প্রশাসনে তদবিরসহ নানা কাজ করেছেন। প্রশাসন, স্থানীয় সংসদ সদস্য, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে মন্ত্রীরা শুনতেন তাঁর কথা। পারিবারিক অনুষ্ঠানে জাহাঙ্গীরের গ্রামের বাড়ি চাটখিলের খিলপাড়ায় একাধিকবার গেছেন অনেক মন্ত্রী। তিনি বাড়িতে গেলেই ছুটে আসতেন স্থানীয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। নোয়াখালীতে যে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে জাহাঙ্গীরের ছিল সরব উপস্থিতি। নোয়াখালীর চাটখিল ও সোনাইমুড়ীতে জাহাঙ্গীর গড়ে তুলেছেন নিজস্ব বলয়। এলাকার রাস্তাঘাট ছেয়ে গেছে তাঁর বড় বড় বিলবোর্ড ও পোস্টারে।

ঢাকার ইপিজেডে ২০০৯ সালে ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। দলীয় নেতাকর্মীরা ঝুট ব্যবসায় হাত দিলে জাহাঙ্গীর প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী পরিচয়ে ফোন করে সরাসরি তাদের প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি করতেন। এ ব্যবসার মাধ্যমে বিপুল অর্থ আয় করেছেন তিনি। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের হুমকি দিয়ে অনিয়মের মাধ্যমে বেশ কয়েকজনকে ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করান। আর এসব করে তিনি গড়েছেন সম্পদের পাহাড়।

নোয়াখালীর চাটখিলের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলমের নির্বাচনী হলফনামা অনুযায়ী, কৃষি খাতে বছরে আয় ৪ লাখ ২২ হাজার ১০৪ টাকা, বাড়ি ও দোকান ভাড়া থেকে আয় ১১ লাখ ২১ হাজার ৫৩৩ টাকা, ব্যবসা থেকে ৫ লাখ ৪৮ হাজার ৫৭৮ টাকা। শেয়ার, সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক আমানত থেকে ৭ লাখ ৪০ হাজার ৭৬৯ টাকা এবং সঞ্চয়পত্রের আয় ১ লাখ ৪৩ হাজার ৫২০ টাকা। চাকরি থেকে ভাতা পান বছরে ৬ লাখ টাকা এবং অন্য উৎস থেকে আয় করেন বছরে ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা।

তাঁর অস্থাবর সম্পদ হিসেবে নগদ টাকা ব্যাংক মিলিয়ে ২ কোটি ৫২ লাখ ২ হাজার ৪৩০ টাকা এবং স্ত্রীর নামে আছে ১ কোটি ১৭ লাখ ৪৬ হাজার ৬০৬ টাকা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ডিপিএস আছে ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, এফডিআর আছে ১ কোটি ৩০ লাখ ৫৫ হাজার ৯৬৮ টাকা। স্ত্রীর ব্যাংক স্থিতি ২৭ লাখ ৯৭ হাজার ৪৫৫ টাকা ও ডিপিএস ১৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।

বন্ড ঋণপত্র স্টক এক্সচেঞ্জ তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয় কোম্পানির শেয়ার আছে ৫৮ লাখ ১২ হাজার ৭০০ টাকা, স্ত্রীর নামে আছে ২৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা। তাঁর সঞ্চয়পত্র আছে ৩ লাখ টাকা, স্ত্রীর নামে আছে আরও ৩ লাখ টাকা। স্ত্রীর একটি গাড়ি আছে, যার দাম হলফনামায় দেখানো হয়েছে ২২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। স্বর্ণ উল্লেখ করা হয়েছে ৭৫ তোলা, যার মূল্য ধরা হয়েছে ৩০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আর স্ত্রীর স্বর্ণ আছে ১০ লাখ ৯০ হাজার টাকা। আসবাব ও ইলেকট্রনিকস সামগ্রী আছে ১০ লাখ ২৮ হাজার টাকা, স্ত্রীর নামে আছে ৯ লাখ টাকা। জাহাঙ্গীর একটি পিস্তল ব্যবহার করেন, যার দাম ১ লাখ ১৯ হাজার ৫০০ টাকা। অংশীদারি ফার্মে তাঁর মূলধন আছে ৬ কোটি ২৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। স্ত্রীর ব্যবসায় মূলধন আছে ৭৩ লাখ ৩৮ হাজার ৫১০ টাকা।

জাহাঙ্গীরের স্থাবর সম্পদের মধ্যে কৃষিজমির পরিমাণ সাড়ে ৪ একর। মূল্য ধরা হয়েছে ১ কোটি ৮২ লাখ ১২ হাজার ১১৫ টাকা। স্ত্রীর আছে ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার টাকার জমি। অকৃষিজমি আছে ৩ কোটি ১৮ লাখ ৭২ হাজার টাকা, স্ত্রীর আছে ১৯ লাখ ১০ হাজার টাকার জমি। ৩০ লাখ ৮০ হাজার টাকার একটি দালান আছে। মোহাম্মদপুর ও নিউমার্কেটে দুটি দোকান, মিরপুরে সাততলা ইমারত, গ্রামের বাড়িতে একতলা দালান মিলিয়ে আছে আড়াই কোটি টাকার সম্পদ। স্ত্রীর নামে আটতলার একটি ইমারত আছে, দাম ধরা হয়েছে ৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা। মিরপুরে আছে দুটি ফ্ল্যাট, যার দাম ৪৪ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। স্ত্রীর নামে রাজধানীর ধানমন্ডিতে ২৩৬০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটের দাম ৭৬ লাখ ১৮ হাজার ৭৫০ টাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *