চট্টগ্রামে মাইকিং করা হাছান মাহমুদের হাতে এখন রাষ্ট্রের মাইক!

জীবনযাপন রাজনীতি

স্কুলে আমার ছাত্ররাজনীতির শুরু। কলেজে ছিলাম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন প্রথম-দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, তখন চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের কোনো জনসভা হলে আমি মাইকিং করতাম। এখন তো সভা-সমাবেশ উপলক্ষে মাইকিং হয় না। তখন কিন্তু সারা শহরে মাইকিং হতো। আমি মাইকিং করা একজন কর্মী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন রাষ্ট্রের মাইক আমার হাতে তুলে দিয়েছেন।’ কথাগুলো বলছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অন্যতম মুখপাত্র ও সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।

১৯৬৩ সালের ৫ জুন চট্টগ্রামে জন্ম নেওয়া ড. হাছান মাহমুদের বেড়ে ওঠা বন্দরনগরেই। ষষ্ঠ শ্রেণীতে বক্তৃতায় প্রথম হয়ে জীবনের মোড়টাই ঘুরে যায় তাঁর। তিনি বলেন, ‘মুসলিম হাই স্কুলের আঙিনায় বহু বছর কেটেছে। এই স্কুলের শিক্ষা না পেলে আমি কখনোই আজকের এই পর্যায়ে আসতে পারতাম না। আমার মনে আছে, ১৯৭৩ সালে আমি মুসলিম হাইস্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হই। একই বছর স্কুল মিলনায়তনে স্বাধীনতা দিবসের আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার শুরুতে নাম চাওয়া হলো যারা বক্তৃতায় দেবে তাদের। দুটি গ্রুপ। একটি হচ্ছে সিনিয়র গ্রুপ, নবম-দশম; আরেকটি জুনিয়র গ্রুপ-৬ষ্ঠ, ৭ম ও ৮ম।’

‘আমি দর্শকসারিতে বসে আছি। আমার একটা বন্ধু ছিল, পাড়ার বন্ধু। নাম অনুপম বড়ুয়া। সে স্কুলের ছাত্র না, সে এমনি আমার সাথে স্কুলে এসেছিল স্বাধীনতা দিবসের আলোচনা সভায়। যখন নাম আহ্বান করলো অনুপম বললো, তুই নাম দেয়। আমি একটু দ্বিধাগ্রস্থ হলে সে বলে, তুই এমনি ফটর ফটর করছ, এখন নাম দেয়। তারপর আমি নাম দিলাম।’

হাছান মাহমুদ বলেন, বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় যখন ফলাফল ঘোষণা করা হয়, তখন দেখি আমি প্রথম হয়েছি। জীবনের প্রথম বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় প্রথম হলাম। এই আত্মবিশ্বাস আমাকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। এরপর আমি স্কুলের সব বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতাম, যতবার অংশগ্রহণ করেছি, দুই-একবার দ্বিতীয় হয়েছি, কিন্তু তৃতীয় কোনো সময় হইনি।’

‘তখন টেলিভিশনে জাতীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতা হতো। সেই বিতর্ক প্রতিযোগিতায় আমি টিমলিডার হিসেবে অংশ নিতাম। যখন কলেজে ভর্তি হই তখন আমাকে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয়। সেটি করার পেছনে বড় বিবেচনা ছিল, আমি ভালো বক্তৃতা দিতে পারি। যারা করেছিল, তারা কিন্তু এখনো বেঁচে আছেন। এখনো রাজনীতি করেন। অর্থাৎ স্কুলের শিক্ষা আমাকে আজকের জায়গায় দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার মনে আছে, ৭ম শ্রেণীতে পড়ার সময় আমি একবার হাই বেঞ্চের উপর বসে বক্তৃতা দিচ্ছিলাম। আমার সামনে বন্ধুরা বসা ছিল। তারা হঠাৎ আমার দিকে একটু অন্যভাবে তাকাচ্ছিল। আমি মনে করেছি, এমনিতে তাকাচ্ছে। পেছনে যে স্যার এসেছেন, তারা আমাকে বলেনি। তারা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেছে। আমাকে কিছু বলতে পারছে না। হঠাৎ পেছনে বেতের বাড়ি, কিছু বুঝে উঠার আগেই। নুরুল ইসলাম স্যার মেরেছিলেন, স্যার এখন বেঁচে নেই। তিনি বিজ্ঞান পড়াতেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত আমি হাই বেঞ্চে বসিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে দূরের কথা, জীবনে আর কোনোদিন আমি হাই বেঞ্চে বসিনি।’

স্কুলে পড়াকালীন বয়স্কাউটের দলনেতা, জুনিয়র রেডক্রস টিমের সদস্য ও জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী হল বিতর্ক দলের দলনেতা ছিলেন হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘নেতৃত্ব দেওয়ার এসব কাজ করতে গিয়ে পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়েছিলাম। ইসহাক স্যার (মুসলিম হাই স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক) একবার আমার বাবাকে গিয়ে বললেন, আপনার ছেলে তো এখন নেতাগিরি শুরু করেছে, কিছু করেন। বাবা একটু মেজাজি মানুষ ছিলেন, আমাকে কষে একটা পিটা দিয়েছিলেন।’

অকাল প্রয়াত নন্দিত সংগীতশিল্পী আইয়ুব বাচ্চুকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করে তাঁর স্কুলজীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হাছান মাহমুদ বলেন, ‘বাচ্চু আর আমি একসঙ্গে মুসলিম হাইস্কুলে পড়েছি। আমরা ক্লাসমেট। ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে এসএসসি পর্যন্ত একসঙ্গে কাটিয়েছি। শুরু থেকেই আমরা স্কাউটিং করতাম। স্কাউটিংয়ে টিম লিডারের অধীনে চারজন পেট্রোল লিডার থাকেন। অষ্টম শ্রেণীতে উঠার পর আমি আর বাচ্চু ছিলাম সেই চার পেট্রোল লিডারের দুইজন। পরে আমি অল্পদিনের জন্য টিমলিডার হয়েছিলাম।’

ছাত্রজীবনে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ১৯৭৭ সালে চট্টগ্রাম শহরের জামালখান ওয়ার্ড ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন হাছান মাহমুদ। ১৯৭৮ সালের শেষার্ধে চট্টগ্রাম সরকারি ইন্টারমিডিয়েট কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৭৯ সালে চট্টগ্রামের সরকারি হাজী মহসিন কলেজ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

স্মৃতিচারণ করে হাছান মাহমুদ বলেন, ‘কলেজে যখন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, তখন আমার বাবা বাধা দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। যাতে আমি রাজনীতি না করি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর রাজনীতি থেকে পিছপা হইনি। বাবাও পরে আর বাধা দিতেন না। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় গ্রেপ্তার হয়েছিলাম। তখন আমাকে চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানা হাজতে রাখা হয়েছিল। আমার জন্য কিছু বইপুস্তক পাঠাতে বাসায় খবর পাঠিয়েছিলাম। বাবা আমার জন্য বেশকিছু বই পাঠিয়েছিলেন।’

১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন হাছান মাহমুদ। ১৯৮৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সিনিয়র সহ সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। তারপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি। হাছান মাহমুদ বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করি। ১৯৮৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় চাকসু নির্বাচনে অংশ নিতে পারিনি ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যাওয়ায়। সে সময় পত্রিকায় লেখালেখি হয়েছিল। বিপুল জনপ্রিয়তা থাকার পরও নির্বাচনে অংশ নিতে পারছি না আমি। ওই নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য রুখে দাঁড়িয়েছিল। সেই ছাত্র ঐক্যের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান ছিলাম আমি। ১৯৯১ সালে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে সভাপতি প্রার্থী হই। সেই বছর ২৮ বছরে পা দিয়েছিলাম। বয়স নির্ধারণ করে দেয়ায় ছাত্রলীগ করতে পারি নাই। প্রথমবারের মতো ছাত্রলীগে সে নিয়ম চালু হয়। ছাত্রলীগের সম্মেলনের কিছুদিন পরে ১৯৯২ সালে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়। সম্মেলনে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মনোনীত হই। কমিটিতে আমিই ছিলাম বয়সে সবচেয়ে ছোট।’

উত্তাল ছাত্ররাজনীতির পাঠ চুকিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য একসময় ইউরোপ চলে যান ড. হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। সে বছর সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্রাসেলস হয়ে নিউইয়র্ক যাচ্ছিলেন। বেলজিয়াম আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিমানবন্দরে আমরা তাঁকে সংবর্ধনা জানাই। বিমানবন্দরে তখন তাঁকে বললাম, আমার লেখাপড়া অনেক হয়েছে। দেশে রসায়নে মাস্টার্স, বিদেশে এসে হিউম্যান ইকোলজি ও আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছি। আপা আমি এখন দেশে ফিরে যেতে চাই। দেশে আমাকে একটা ছোটখাট কাজে লাগিয়ে দিন। তখন তিনি বললেন, তুমি পিএইচডি করোনি। পিএইচডি করে আসো। পিএইচডি করে আসলে ছোট নয়, অনেক বড় কাজে লাগিয়ে দেব। পিএইচডি করে না আসলে তুমি তোমার চেষ্টায় যা পার সেটা করবে। আমার কোনো সাহায্য সে ক্ষেত্রে পাবে না।’

তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হাছান মাহমুদ বলেন, ‘পিএইচডি করতে ৪ বছর সময় লাগবে। এই সময়ে রাজনীতিতে আমি পিছিয়ে পড়বো।’ এরপরও প্রধানমন্ত্রী বললেন পিএইচডি করেই দেশে ফিরতে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বেলজিয়ামে এনভায়রনমেন্ট কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি শুরু করেন হাছান মাহমুদ। বেলজিয়ামের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ড. হাছান মাহমুদ বলেন, বেলজিয়ামে পড়ার সময় প্রথম বছরে সীমিত স্কলারশিপ পাই। এ দিয়ে আমার ঘরভাড়া ও খাবার-দাবার চলতো। তারপরও আমি বাড়তি আয়ের জন্য ছুটির দিন কাজ করতাম। সঞ্জয় বাবু নামে দিনাজপুরের এক সহপাঠি ছিলেন। তিনি আর আমি এক সাথে থাকতাম। একদিন ছুটির দিনে আমরা দু’জন একটি মেলায় সেল্সম্যানের কাজ খুঁজতে গেলাম। কেউই কাজ দিলেন না। কারণ সবার সেল্সম্যান আছে। মেলায় এক বয়স্ক মহিলা বললেন, আমার সেল্সম্যান লাগবে না। তোমরা একটা কাজ করো ট্রাকে করে আমাদের যে মালগুলো আসবে, সেগুলো আনলোড করতে পার। আমি আর সঞ্জয় বাবু শেষ পর্যন্ত এ কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। বেশ কয়েক সপ্তাহ আমরা ট্রাকে মাল লোড-আনলোড করেছি। এছাড়া ছুটির দিনে পিজারিয়া, মেকডোনাল্ডসেও কাজ করেছি।’

এভাবে কঠিন সময় পার করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন হাছান মাহমুদ। এরপর ২০০১ সালে দেশে ফিরে আসেন। একই বছর নভেম্বরে জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে বিশেষ সহকারি হিসেবে নিয়োগ দেন। ২০০২ সালে আওয়ামী লীগের পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক করেন। এভাবে তিনি যুক্ত হন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতির সঙ্গে। পাশাপাশি ঢাকায় ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন হাছান মাহমুদ। সেখানে তিনি এনভায়রনমেন্ট সায়েন্স ও বাংলাদেশ স্টাডিজ পড়াতেন। গত ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দুই মাস আগ পর্যন্ত সেখানে শিক্ষকতা করেন।

শিক্ষকতা জীবন সম্পর্কে ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতাম তখন আমার কথাবার্তায় কাউকে বুঝতে দিতাম না, দেশের রাজনীতিতে আমি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমাকে টেলিভিশনে দেখে ছাত্রদের কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করতে চাইলেও আমি কখনো তাদের সেই সুযোগ দিতাম না। শিক্ষক হিসেবে সবসময় চেষ্টা করেছি, আমি যে রাজনীতির মানুষ সেটা একদমই যেন প্রকাশ না পায়। শিক্ষকতায় রাজনীতির কোনও প্রভাব পড়ুক সেটা কখনো চাইনি। নির্বাচনের পর যখন মন্ত্রীসভায় স্থান পেলাম, ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি আমার সম্মানে সংবর্ধনা সভা করেছিল। সভায় ছাত্ররা বলেছেন, স্যারকে সব সময় টেলিভিশনে দেখতাম, তিনি যখন পড়াতেন তখন রাজনীতিরও সমালোচনা করতেন মাঝে মাঝে। পাঠদানে রাজনীতিবিদ প্রভাব থাকতো না।’

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিরোধীদলের নেত্রী শেখ হাসিনার বেশ কয়েকজন বিশেষ সহকারি ছিলেন। তার মধ্যে দুইজন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। গা ঢাকা দিয়েছিলেন অনেকে। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিলেন হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘আমি তখন মনে করেছি আমার দায়িত্ব নেত্রীর পাশে দাঁড়ানো। সত্যকে প্রকাশ করা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। সেজন্য গ্রেপ্তার নিশ্চিত জেনেও আমি দায়িত্ব পালন করে গেছি। এমনকি সে সময় জানতাম আমাকে যে কোন মুহূর্তে গ্রেপ্তার করা হবে। এজন্য আমার ব্যাগে একটা লুঙ্গি, শার্ট, টাওয়েল, টুথপেস্টসহ প্রয়োজনীয় ওষুধ থাকতো। প্রতিদিন মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলে বাসায় ফিরতাম। আমার স্ত্রীকে বলতাম আজকে হয়তো পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যাবে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে আমাকে গ্রেপ্তার করার সুযোগ পায়নি পুলিশ।’

২০০৭ সালের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘২৭ জুন আমার ছোট ছেলে সাফওয়ান আরহাম মাহমুদের জন্ম। নেত্রী গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েকদিন পরে আমার শাশুড়ি নবজাতক সন্তানকে দেখার জন্য ঢাকার বাসায় যান। চট্টগ্রাম থেকে মেহমানরা গেছেন সেজন্য বাসায় ভালো খাবারের ব্যবস্থা হয়েছিল। রাতে আমি বাসায় খাচ্ছি। সে সময় এক সাংবাদিক আমাকে ফোন করলেন। আপনি কোথায়? আমি বুঝতে পারলাম- আমার অবস্থান জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। তখন ওই সাংবাদিক বললেন, আপনাকে কি গ্রেপ্তার করা হয়েছে? আমি বললাম- না, অন্য জায়গায় আছি। তখন আমি খাবার ফেলে অন্ধকারে বেরিয়ে যাই। খাবার টেবিল থেকে সেদিন চলে যেতে হয়েছিল। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গ্রেপ্তার এড়াতে আমি প্রায়ই বাইরে রাত কাটাতাম। আরেকদিন বাসায় এসেছি। স্ত্রীকে বললাম-যা ঘটুক না কেন, আজকে বাসা থেকে যাব। স্ত্রী সারারাত পাশে বসে নামাজ পড়েছে, আল্লাহকে ডেকেছে, যাতে আমি গ্রেপ্তার না হই। তার ধারণা ছিল। পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যাবে।’

ড. হাছান মাহমুদ তার নিজ নির্বাচনী এলাকা চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে বলেন, ‘ছাত্রজীবন থেকে রাঙ্গুনিয়ার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হই। সেখানে বিভিন্ন কলেজ, এলাকার নানা অনুষ্ঠানে আমি যেতাম। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে রাঙ্গুনিয়া থেকে নমিনেশনও চেয়েছিলাম। তখন সভানেত্রী আমাকে বলেছিলেন, এখন বয়স কম, তোমাকে পরেরবার দিব। দেশে ফেরত আসার পর রাঙ্গুনিয়ার রাজনীতিতে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ি।’

রাজনীতি ও মন্ত্রীত্বের দায়িত্ব নিয়ে প্রতিদিন ব্যস্ত সময় পার করেন ড. হাছান মাহমুদ। এরপরও প্রায় প্রতি সপ্তাহে তিনি নিজ নির্বাচনী এলাকা রাঙ্গুনিয়ায় যান, এলাকাবাসীর খোঁজ নেন। এসব দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পরিবারকে আগের মতো সময় দিতে পারেন না। এতে আক্ষেপ থাকে সন্তানদেরও। ড. হাছান মাহমুদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘একদিন আমার ছোট মেয়ে আবিরা নাওয়ার মাহমুদকে তার স্কুলের শিক্ষক বলেন বাবাকে নিয়ে রচনা লিখতে। তখন সে লিখেছে, বাবা খুব ভালো। বাবা তাকে খুব আদর করে। সে-ও বাবাকে খুব পছন্দ করে। কিন্তু তার বাবা মন্ত্রী, এটা সে পছন্দ করে না। বাবা আগে তাদের নিয়ে ঘুরতে বের হতেন। মন্ত্রী হওয়ার পর সে সকাল ৭টায় যখন স্কুলে যায়, তখন তার বাবা বিছানায় থাকেন, আর রাত ১১টায় যখন সে ঘুমাতে যায়, তখন বাবা মানুষজনের সাথে নিচের তলায় থাকেন। তাই বাবাকে আর দেখে না।’

এখন জাতীয় রাজনীতির মূল চরিত্রের মানুষ, নাটকের মানুষদের অভিভাবক- ড. হাছান মাহমুদ। অথচ এ মানুষটিই একসময় নাটক করতে চেয়েও সুযোগ পাননি। তির্যক নাট্যদলে যুক্ত হয়ে কিছুদিন ‘নাটকের সেট’ টানাটানিও করেছিলেন, কিন্তু ফাইনালি ‘রোল’ পাননি। হ্যাঁ, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ নিজেই দিয়েছেন এই তথ্য। তিনি বলেন, ছাত্রজীবনে আমি তির্যক নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম হায়দার (আহমেদ ইকবাল হায়দার) ভাইদের সাথে। কিছুদিন নাটকের সেট নিয়ে টানাটানি করলেও নাটকে ‘রোল’ পাইনি। বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের একটি অনুষ্ঠানে মন্ত্রীর এমন সরল স্বীকারোক্তিতে হাসির রোল পড়ে মঞ্চ ও অডিয়েন্সে। এসময় মন্ত্রী নিজেও হাস্যরসে শামিল হন, মজা করেন।

তরুণদের প্রতি হাছান মাহমুদ বলেন, ‘আমার শিক্ষক-অভিভাবকরা আমাকে যেভাবে পরামর্শ দিয়েছিলেন, সেগুলো যদি পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করতাম, জীবন চলার পথে আরো বহুদুর এগিয়ে যেতে পারতাম। মন্ত্রী হওয়া, মন্ত্রীর আসনে বসা একমাত্র জীবন চলার পথে বহুদূর এগিয়ে যাওয়া নয়। বহুদূর এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আরো বহু অনুষঙ্গ আছে।’

হাছান মাহমুদের মতে, পৃথিবীতে সবচেয়ে মূল্যবান বিষয় হচ্ছে সময়। সময় যেটি বয়ে যায় সেটি কখনো ফেরত পাওয়া যায় না। কারণ কারো যদি স্বাস্থ্যহানি হয়, সেই স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করা যায় হয়তো, কারো যদি ব্যবসায় লোকসান হয়, সেই লোকসানও পুষিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু বয়ে যাওয়া সময় ফেরত আনা যায় না। সেই সময়ের মধ্যে মূল্যবান সময় হচ্ছে ছাত্রজীবন।’ তিনি বলেন, ‘ছাত্রজীবনের সময়টি যে ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারবে, সে জীবনে উন্নতি লাভ করবে। জীবন চলার পথে দেখেছি, অনেক মেধাবী ছাত্র পরবর্তীতে সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেনি এবং হারিয়ে গেছে। তবে হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ বিল গেটস, আজকে পৃথিবীকে বদলে দিয়েছেন মাইক্রোসফটের মাধ্যমে।

‘বিল গেটস কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেল করার কারণে বহিস্কৃত হয়েছিলেন। যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিল গেটস বহিস্কৃত হয়েছিলেন, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিল গেটসকে নিয়ে গবেষণা হয়। তার অর্থায়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক প্রকল্প পরিচালিত হয়। সুতরাং ফলাফল খারাপ হলে হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। এরকম অনেক মানুষ পৃথিবীতে আছেন যারা ফলাফল ভালো করেননি, কিন্তু জীবন চলার পথে অনেককে ছাড়িয়ে গেছেন।’

গত ১৪ বছরে জনপ্রতিনিধি হিসেবে সব মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন বলে জানান চট্টগ্রাম-৭ আসনের সংসদ সদস্য ড. হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘কোনো মানুষকে আমি সহজে ফেরাই না, না বলি না। সে যেই হোক। সে কোন দলের, কোন পথের-মতের সেটি আমি কখনো বিবেচনায় আনি না। দলমত নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য আমার দুয়ার খোলা রেখেছি। কোনো একটা মানুষ আমার কাছে সাহায্যের জন্য আসলে চেষ্টা করি সাহায্য করার জন্য। সব কাজ যে আমি করতে পারবো কিংবা করে দিতে পারবো সেটা আমি বলবো না, তবে আমি চেষ্টা করি।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *